রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেনীর আলোচিত নুশরাত হত্যায় পিবিআই’র প্রতিবেদন

নিউজ ডেস্ক [] আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় হুকুমদাতা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে দায়ী করে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) প্রস্তুত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের এই চার্জশিটে ১৬ আসামির প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও রাফী হত্যাকান্ড ঘটনায় জড়িত কার কী ভূমিকা ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছে।

আজ আদালতে অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য জানান। দেশজুড়ে আলোচিত নুশরাত জাহান রাফী হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে নিহতের স্বজনসহ সারা দেশের মানুষ।
ইতোমধ্যেই পিবিআই অভিযুক্ত সব আসামিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনায় তদন্ত সংস্থাটি নানা মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

পিবিআইয়ের এই তদন্তে গতানুগতিক চার্জশিটের বাইরেও নৃশংসতার চরম বহিঃপ্রকাশ ও সামাজিক অবক্ষয়ের মতো বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে ১৬ জন একে অন্যের সঙ্গে প্রত্যেকে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। তাদের এই অপকর্মের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। তাই ১৬ জনের প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে ও সুস্থ মস্তিষ্কে এই হত্যাকান্ড ঘটায়। ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণি ও পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন ও শিক্ষার্থী। খুনের পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষাও যে দেওয়া সম্ভব তা ভাবনাতীত। এ ঘটনা শিক্ষণীয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

অভিযোগপত্রের আসামিরা হলো মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা (৫৭), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ ও একই মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন (২০), ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), ওই মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), ছাত্র আবছার উদ্দিন (৩৩), রাফীর সহপাঠী কামরুন নাহার মনি (১৯), সহপাঠী উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আবদুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০) ও মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।

বনজ কুমার বলেন, সার্বিক তদন্তে মামলার ঘটনার বিষয়ে জানা যায় যে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে রাফীর মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেফতার করা হলে তার অনুগতরা ক্ষিপ্ত হয়। হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একাধিকবার বৈঠকও করে তারা। হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নেওয়ায় আসামিরা রাফীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ঘটনার দিন রাফীকে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দেয় পাঁচজন। এর মধ্যে তিনজনই ছিল পরীক্ষার্থী। ওইদিন পরীক্ষা থাকায় এ ঘটনার পর পরীক্ষায়ও অংশ নেয় তারা। রাফীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার ও প্রত্যক্ষ হত্যাকা- জড়িত পাঁচজনের তিনজনই এই অপকর্ম শেষে হলে ঢুকে পরীক্ষা দেওয়ায় পূর্বপরিকল্পনা বোঝা কঠিন ছিল। রাফী অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসার সময় দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শরীরে কাপড় ছিল না। কাপড় পুড়ে গিয়েছিল। শরীর থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছিল। গেটে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। হত্যায় জড়িত নুর উদ্দিন ও হাফেজ আবদুল কাদেরও রাফীর গায়ে পানি দেয় এবং ভাই নোমানকে ফোনে খবর দেয়। পরে হত্যাকান্ড সংঘটিত করার পর সবাই নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়। পিবিআই প্রধান জানান, এই হত্যাকান্ডে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা ও ফেনী আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ ১৬ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

এজাহারের বাইরে তদন্তে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় আরও আটজনকে অভিযুক্ত করে বুধবারই (আজ) আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। এতে ১৬ জনের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড চেয়েছে পিবিআই। বহুল আলোচিত এই হত্যাকান্ডে ১৬ জন জড়িত। অভিযুক্ত সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

রাফী হত্যাকান্ডে কার কী ভূমিকা ছিল : পিবিআই জানিয়েছে, এ ঘটনায় ১৬ জন নানা ভুমিকা পালন করে। তার মধ্যে হুকুমদাতা হিসেবে কাজ করেছে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা।
এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা : হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও এর চেয়ে বেশি করেছে। তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাতে কাজ না হলে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে তাকে হত্যার নির্দেশনা দেয় সিরাজ। কীভাবে হত্যা করতে হবে তার নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও দিয়েছিল অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার পরামর্শও দেয় সে।

অধ্যক্ষের অন্যতম সহযোগী নুর উদ্দিন : হত্যাকান্ডের আগে যে কক্ষে বোরকা রাখা ছিল, সেটি পরিদর্শন করে আসে সে। ঘটনার সময় ভবনের নিচের পরিস্থিতিটা খুব চাতুরতার সঙ্গে সামলে নেয় নুর উদ্দিন। পুরোটা সময় নাটকের মতো চিত্রায়ন করতে সহায়তা করে।
মাদ্রাসাছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম : রাফীকে হত্যার আগে পরিকল্পনার বৈঠকে উপস্থিত ছিল শামীম। কীভাবে কে-কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা সাজায় শামীম। সে কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়। যে টাকা দিয়ে বোরকা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পরে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বোরকা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্ল্যাভস উদ্ধার করা হয়।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় কাউন্সিলর মাকসুদ : রাফীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় মামলা হলে আটক হয় অধ্যক্ষ সিরাজ। এরপর গত ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেয় মাকসুদ আলম। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেয়। হত্যাকান্ডের জন্য সে ১০ হাজার টাকা দেয়। সবকিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেনীতে অবস্থান করছিল মাকসুদ আলম।
ছাত্র সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের : সে ঘটনাস্থলে রাফীকে শোয়ানোর পর পা বেঁধে দেয়। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ছাত্র জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন : সে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালে। নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুবই ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে চলে যায়। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যায়। এমনভাব করে যেন সে কিছুই জানে না।

ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের : সে নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহারায় ছিল। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না, ভাই নোমান দেখতে চাইলে কাদের তাকে বাধা দেয়। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয় জানতে চাইলে কাদের জানায়, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে সে জানায়, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

আবছার উদ্দিন : ঘটনার সময় সে গেট পাহারার দায়িত্বে ছিল। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও আগের মামলার বাদীকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।

রাফীর সহপাঠী কামরুন নাহার মনি : শামীম তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে বোরকা ম্যানেজ করতে বলে। এ টাকায় দুটি বোরকা ও হাতমোজা কেনে সে। কেনা দুটি বোরকাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরকা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসে। ছাদে উঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করে এবং বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে রাখে। ঘটনার পর ঠান্ডা মাথায় এসে সেও পরীক্ষায় অংশ নেয়।

সহপাঠী উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা : নুসরাতকে ছাদে উঠানোর পর মামলা তুলে নিতে প্রথমে চাপ দেয় পপি। রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ের ওড়নাটি বের করে পপি। এরপর ওড়নাটি দুই ভাগ করে দেয়, যা দিয়ে নুসরাতের হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছন দিয়ে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাভসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়, যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।

আবদুর রহিম শরীফ : সে বাইরের গেটে পাহারায় ছিল। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় আবদুর রহিম।

ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল : তারা গেটে পাহারায় ছিল। সবকিছু স্বাভাবিক বোঝাতে যা যা করণীয় তা করছিল তারা।

ছাত্র মোহাম্মদ শামীম : সে প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিল, যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে এবং এর ফলে অন্য কাউকে খুন করতে না হয়, সেজন্য সতর্ক ছিল সে।
সোনাগাজী আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন : ঘটনার পর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ-প্রশাসন সবকিছু ম্যানেজ করার আশ্বাস দেন তিনি। হত্যাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেন। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দু’দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত হন তিনি।

Comments are closed.

More News Of This Category